Friday, February 1, 2008

প্রারম্ভিকী

খোঁড়ো এই ভূমিতল স্বতোঅবসরে
কোটি কোটি পল ক্ষণ নিমেষ ও ঘণ্টারাশি
যুগপৎ ধরা যেথা রক্তমাংসসমেত

জেনো সময় কখনো বাঁচে একা নয়
মিশে থাকে মণিমঞ্জুষা : সুদূর--
অমেষ অভিজ্ঞাস্রোত
প্রবল ভাঙন ঢেউ
অবদমনের যতো চরা
নিহিত অসূয়াকুটা
সুখাসুখ কাদা
দম্ভচূর্ণ
সম্ভব স্বপ্নকামনা ফেনা
তাড়িত আবেগবাষ্পকথা

চিদানন্দে নির্মিত এ তুরীয় আলোকপথ
মোহিত ললিত মনসিজ মনীষার ছায়া
প্রতিবেশী ধ্বনিবর্ণরাগে

ঘোর এ যাপনচিত্রমালা : অস্তিত্বের--
থরে থরে পোতা র’লো কুমারী কাগজে

সসতর্ক খুঁড়ে দেখো কখনো এ ভূমিতল
মমি উপত্যকা

হৃদগভীরের শিলালেখ

গুহাচিত্রিদের মাঝে ছিলাম আমি একসময়
তীরের ফলায় গাঢ় রঙের যোগান দিতে জীবিত ছিলাম
চকমকি পাথরের গায়ে যে অগ্নির দ্যুতি
সূচাগ্র চূড়ায় তার মিশেছিল সৃজন-উল্লাস

কস্তুরী মৃগের নেশায় যতটা হেঁটেছি পথ
ন্যূনতাই এঁকেছি দেয়ালে তার গুহায় গুহায়
আর ঘোর এসে যখন জাপটে ধরে পঞ্চেন্দ্রিয়
এবং ষষ্ঠসমেত সৃজনবিন্দুকে
তখন নারীর অধিকার মার খায় দিকে দিকে
যে-কারণে নারী আসে বেঁকেচুরে অসম্পূর্ণতায়
অথচ যায় না গ্রহণ করাও তাকে
প্রচুর গ্রহণ-অসমর্থ শুধু চি-চি
ফাঁকা কথার আধারে তত চিড়েও ভেজে না

কোথাও তখন দেখি উন্মাদনা নেই
কুসুম পালক নেই
রাতের নয়ন জুড়ে শ্রান্তঘুম দ্রুততর নামে

অতর্কিত এক অভীপ্সায় বেঁচে থাকা প্রলম্বিত হয়
তারই ছাপ মুদ্রিত গভীর গুহার দেশে
এতদিনে কতটা বা খুঁজে পেলে তার--
বেড়ে ওঠা গানের গভীর থেকে
স্বপ্ন-আল্পনাঘন অধীর যাপনের লীলায়িত রেখাবলি
সারে সারে পাথর মধুর করে মহীয়ান হয়--
আমার হৃদ্গভীরেও এর বেড়েছিল সহস্র শেকড়

নাব্যতার গল্প

তীরাভরণ শোভিত নাব্য কলস্বনা
উভদিকে বহন করছ এতসব চোখ
ইতিউতি তাকাবার অমেয় আগ্রহ আর
দূরচক্রবালে শুদ্ধ বীক্ষণ-কৌশল

যূথবদ্ধ অনঘ-প্রভায় আমরা ছিলাম মুগ্ধতর হাজার বছর
স্বকীয় অঢেল ছিল বিচ্ছুরিত আলো এই দূরধন্য বাতিঘরে
চিন্তন চর্চিত মেধা গড়েছিল দর্শনের মরমীয় অরূপ নগর
রাশি রাশি জ্ঞানপীঠ খুলে গিয়েছিল যথা উজ্জয়নীপুরে

জলপথে যারা এল উঞ্ছবৃত্তি সমভিব্যাহারে
রেখে গেল ভোগলিপ্সা-- গতি
আকরিক লোহা আর তার বস্তু-ব্যবহার
লুটে নিল আত্মার গন্ধে মোহিত স্বস্তিঅস্তি ফুল
চিত্তের বৈভব যত বনমুগ্ধতার

বহুপথ দূরে দূ...র পথে বেঁকে গেল ভারত-নাব্যতা
অসবর্ণ পলিফোনি বিষম মিশ্রণে
বিদিশা ও মোহনার ঘোলাবহজলে
শনৈঃ শনৈঃ অশ্বতর ধাবন-- শুধু একার্ণবের পানে...

ছন্নছাড়া কবিতা

মাথার ভেতরে এক জ্বলজ্যান্ত মরুভূমি নিয়ে আমি আফ্রিকা থেকে ক্রমে এশিয়া ইউরোপ হয়ে নিত্য ফিরে আসতে লেগেছি নিজগৃহে-- অধীর অশান্ত স্ত্রী আমাকে জানিয়েছে এটা ভয়ানক, এতে নাকি বালির প্রভাঁজে শুয়ে ক্যাকটাস গিরগিটি ও বিষাক্ত সাপখোপ সঙ্গী হতে পারে-- গত বছর তো আমি বাঁ’হাতে ঝুলিয়ে খোদ বঙ্গোপসাগর, পৌঁছে গিয়েছিলাম ঠিক শ্বশুরবাড়ি, সেবার বন্যায় ভেসে গিয়েছিল সব্বাই শ্বশুর মহলের-- এমনকি ও-বাড়ির পোষা বিড়ালিও, ভাতের থালায় হাত দিয়ে টের পেয়েছিলাম যে কী ভীষণ জলোরাজ্যে আমি সমর্পিত আজ, বিছানায় উঠে এসেছিল গর্জনশীল মোহনা-- জাপটে ধরা বিষখালির পাক দেয়া জলের বাহিনী

সাহারায় এবারের আমার যাওয়া প্রধানত শখবশে নয়-- এক ভোরে জেগে দেখি ধুধুতর সব, মাথা ও পকেট জুড়ে পাতা খাঁখাঁ শুষ্ক এক বালির বিছানা আর দু’পায়ে সতত-চলা চাকা লেগে আছে, যতদিকে যত ছিল প্রেম-ট্রেম ছিঁড়েখুঁড়ে পকেটে গুটিয়ে নিয়ে মুখ ধুয়ে শুরু হলো যাতায়াত, কেননা ভ্রমণে আমার দারুণ মনোটান ছিল-- যুবক স্বভাবে ঘোর ছন্নছাড়াপনা তদুপরি চাকা, সেই থেকে ঠিকানাবিহীন ঘুরে আমেরিকা শেষ হলে অতলান্ত পাড়ি দিয়ে সহসাই বাড়ি ফিরে আসি, নিজহাতে গুছাই বিছানা আর দুইজনে ক্লান্ত হয়ে সারারাত চিকচিক বালিময় মুখ গুঁজে থাকি--

স্ত্রী যদি জিজ্ঞাসে ফের-- বলব যে : পৃথিবী ও সুখাসুখ গোলাকার-- এই কথা বারেবারে প্রমাণ দিতেছি

অপেক্ষাসুদূর

অপেক্ষাসুদূর এই গাছ
বহু শাখা পরিশাখা ধরে রেখাধ্বনি চলে গেছে দূরে
আবির বরণ যত আশা সব বেদনাবিধুর পাখি
সুরের শরীরখানি দুয়েন্দে জড়ানো ভেজা রোদনস্বভাবী

উদ্গীরিত বিজনমণ্ডলে-- কুহুতলে
উদেছিল অরুণার অমিত আঁচল
ঈশানে-নৈর্ঋতে না অতলে-আকাশে সে হেসেছিল
চূড়ার সমান ছিল যতেক বিনতিস্বর
বাতাসের প্রতি নাকে-- নাসারন্ধ্রে
ফুলিত-ফাঁপিত সব রূপের এসেন্স গেছে ফেলে

কে নিয়ে বসতে দেবে তেমন যোগানে-- যেখানে এ হিমালয়
স্রাবিছে অঢেল সুধা পুচ্ছ রাশি রাশি
কোথা এর স্থান হবে কোন অপনদে

সবুজপ্রবাহ জুড়ে এলোমেলো বিদিশারা কুয়াশা ছড়ায়
লোলচর্মসার আশঙ্খিপদ্মিনী যত মুহূর্তনিমেষকাল--
দাশবাবু আর তার বনলতা
পাখির দেউড় ঘেরা নীড়ের আরামশোভা ঢেলে যায়
মেখে যায় তন্ময় শুশ্রূষা
বাক্যের গভীরে যদি দেখি সবিশেষ-- বোধকরি
এখানেও সেইরূপ শান্তিরা রয়ে যেতে পারে...

যেথা রোদনরূপসী বসা সেখানেই মন খুঁজে পাশ
নিকষপাষাণ যেন-- এখানেই আছে ভাবি বিকেল প্রাণনাটুকু
লুকোছাপা হয়ে-- সকলের চোখে দিয়ে ধুলোছাই
আজ এই সহস্রাব্দ সময়ের মোহনায়
নবতার ঘোলা-ঢেউয়ে স্রোতে

একটা জীবন তবু পুড়ে গেল ক্ষুধাতুর দুপুরের দাহে

আলেয়াপুরীতে

গিজগিজে ‘নেই’-কণ্টকিত এক মরুময় অধিত্যকা জুড়ে লোচনচাতুরী
শুধু দেখা নয়-- নিপুণ তল্লাশি-- যেন এড়িয়ে না যায় কোনো কণাঠাঁই
যেন বালিয়াড়ি আঁকা সেই মরু-সংসারে যত বিছানা-বালিশ যত ঘটি-বাটি
তোরং আর মরুজ আয়েসরীতি উল্টিয়ে দেখা হয় সবকিছু
তেমন গোয়েন্দা কৌশলে কোথাও লুকিয়ে-চরিয়ে শেষে থেকে গেল কি না কোনো
টই-টই গন্ধ ভরা ঘাসে ঢাকা প্রিয় ‘আছে’-ফুল

অসংখ্য ‘নেই’-এর ভিড় ঠেলে জ্বলজ্যান্ত ‘আছে’ খুঁজে পাওয়া হলো আসল ফকিরি

কয়লাতামস

এত যদি সুখসন্ধিৎসা
মোহের বিস্তার
ধরো
তমসার তীর ধরে যেতে যেতে একদিন
এ শরীর প্রাপ্ত হলো কয়লাখনির রূপ
শরীর যেহেতু তাকে প্রাণময় ভাবো
অপ্রাণেও যেরকম প্রাণ থাকে জড়ধর্মের--

হাজারো শ্রাবণ গেল তারপর একে একে
শরীর-পরিধি জুড়ে জমা হলো চাপ চাপ স্বর্ণরেণু
সম্ভবতার অধিক গাঢ় কুঞ্জলিপ্ত রোদ
ঘুমন্ত ও লুকানো সে বিলাসধাতুর মোহে
তখনো কি ভাসবে না কয়লাতামসে
তবু

বিদিশাবাহিত

দিশা এসে ঠেলে দিল বিদিশায়-- অপাঙ্গআঁধারে
পথগুলো পথে নেই-- কোথায় বেড়াতে গেছে
সমূহআসন জুড়ে কাঁটার প্রসার

স্মৃতিকে জিজ্ঞেস করি-- গেলবার
পুবদেশে কোনো কিছু ফেলে কি এসেছ
স্বপ্ন কি আশা-- মন কি মনোযোগ
স্তব্ধতা মুখিয়ে থাকে রহস্যনিগূঢ়

চারুসূত্র যতটুকু জানি-- দেরি হয়ে গেছে
দিনানুকুয়াশা ঘেরা এই সংশয়ে
নিজেরই বিরুদ্ধে শুধু যুঝে যেতে হবে

গ্রামনিশি অথবা কিচ্ছার কলরবগুলি

সান্ধ্যকুয়াশার পাখনায় ভর করে শ্রান্তিরূপ নীরবতাখানি
দূর সৌরপুরী থেকে ক্রমে পৃথিবীতে নেমে এলে
পথের পাশের গ্রাম জুড়ে বাড়ি-পোষা বনের পশ্চাতে
ভোজনের নৈশপ্রস্তুতি ঘিরে উড়ে চলে ঢেউ খেলানো ধূম্রবাহিনী--
কালচে সবুজ পাতা মৃদু মাথা নেড়ে আবাহন করে ঘুম
গ্রামশিশুদের চোখে-- পেয়ারাবাগান ঘেঁষে শুধু এক জাগরণ খেলা করে
পশমি মাফলারের মতো পেঁচিয়ে রাখে কৃষকপাড়ার মুগ্ধতর চোখ
হ্যাজাকের ক্ষীণালোয় অমল মহিমা নিয়ে আবির্ভূত হন সোনাভান
সে আবেশে বাঁকা ভেজা সরুচাঁদ ঘেসো আলপথে
স্বপ্ন দেখে দূর দূর পথ হেঁটে গৃহে ফিরে আসে

সন্ধ্যা যেভাবে ক্রমশ রাত্রির গভীরে আনে শীতল আঁধার
তেমনি কিচ্ছার কলরবগুলি জীবনের জটিল রেখায় মাখে
দীর্ঘজীবী একেকটি আনন্দধারণা-- কাঁচা গোল প্রকৃষ্ট স্বপ্ন অপার

বিশেষ বর্তনকলা

ক্রোধের পর্বত হয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে তপ্ত মনোভাব
মানে মনোবিকিরিত রশ্মির অরব সিনারিও
কতটা প্রবল বেগে প্রেমের প্রবাহ এলে তার দিকে
গলনাঙ্কে নেমে আসে জলের অহম আর
গলিত বরফধারা গাত্র বেয়ে নেমে আসে নিচে
অভিমানে

অভিমানের তরলে যে পাথরখণ্ডগুলো ডুবন্ত ও স্থির
জলোদেহে উদ্দাম নৃত্য জাগিয়ে
ধবলভ্রমণে
তাদেরে বাউল করে সাথে পেতে
প্রধানত কী কী লাগে--
সে কি গৃহ স্বর্ণডিম্ব হংসী এবং ধ্রুপদী কবিতা

গৃহ ও অরণ্যবাসে দৃষ্ট পার্থক্য যদিও প্রধানত
শয়নভঙ্গিতে রচিত এবং খচিত আকাশখানি প্রায়শ নিমিত্ত হয়
প্রেমভেদ শনাক্তকরণে
কোথায় কে কতখানি মুক্ত ও চঞ্চল

অরণ্য বা গৃহ যেখানেই হোক
যত দ্রুত যাওয়া চলে অভিমান থেকে
তত দ্রুত ক্রোধ থেকে নয়

সম্পর্ক : কবিতা ও শস্যে

আপাত অসম্ভবের মোড়ে মোড়ে
বাক্যকে পরাতে গেলে নব-পরিচ্ছদ
মিথ্যা গন্ধ এসে নাকে লাগে

উপলব্ধি হলো শিল্পীর ঈশ্বর
পোষকের চিত্তের গৌরব খেয়ে বাঁচে
আর ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেব সব শৈলীকলা
গমনাগমন যত ভাব পরিবারে

সৃজনপ্রক্রিয়া খুব কাছে থেকে দেখা গেলে
শেকড় ও ডালের বিস্তার বেশ জানাবোঝা হয়
কেমন বপনপ্রণালি হলে কতটা ধানপান
কতটা উল্লাস ঠিক সহনীয় বীজের শরীরে--

খরিফ শস্যের অভিধানে লেখা আছে
সেচ দেয়া জলের তুচ্ছতা তৃষ্ণামলিন মূল বোঝে সমধিক

বৃষ্টির স্বতঃস্ফূর্ত জল
শস্য ও কবিতাকাজে খুব দরকারি

দূরে কোথাও এখন

খাঁখাঁ খরাদেশ থেকে দূ...রে
কোথাও এখন
বৃষ্টির গর্জনধ্বনি বাজে
তার বার্তাবাহী বায়ুদূত
ওড়না দুলিয়ে তুমি এদিকে পাঠালে

চারুকৃত দুরন্ত উড়াল শেষে
বায়ুদল লুটিয়ে পড়ছে নানা কলাকাজে
এপাড়ের উষ্ণিত গর্জনশীল
তনু

গাছে

গাছে

সুদীর্ঘ দূরত্ব দেয়াল ছাড়িয়ে
ওইপাড় জুড়ে গমনাকাঙ্ক্ষাটি
ক্লিন্ন কসরতে চেপে রাখি
--অশোভন বলে

বাতাস জানান দিলে সুনসান
তোমারি সে বৃষ্টি উৎসব
তুমিই সে ধারা বহমান
শিশু ও কিশোর মেঘে ক্রমে আজ যৌবন-উন্মেষ
নাতিদীর্ঘ অপেক্ষার চূড়ান্ত হয়েছে

আসো-- এপাড়ের মরাঘাসে খরাদেশে
হতাশ্বাসে ঢেলে দাও সুরঘন গান
মনোময় স্বপ্নে ভাসে প্রফুল্ল উদ্যান

হারানো কৈশোর ও ভাঙাগান

বাদামের খোসা যেন হারানো কৈশোর-- বয়সের ভারে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো-- পড়ে আছে নদীপাড়ে-- স্রোতেও যায় নি ভেসে-- থেকে গেছে স্মৃতিরাশি হয়ে-- হীরের টুকরো যেন গতিকে বোঝে না

এতদিন এতরাত গত-- ছাতিমের ঝরে গেছে কোটিফুল কত পাখি চলে গেছে দূরদেশ-- ভাঙা যত গান-- থেকে গেছে পালকের মতো অমলিন বায়ু-ভাসমান-- স্মৃতির আকাশ বড়ো প্রসারিত দিকচক্রবালে-- যতসব কথার ঝঙ্কার মমি হয়ে আছে কালে কালে-- আরো বহুকাল সে কি রয়ে যাবে

এখনো পাখিরা খুব গান করে-- যদিও বুঝি না তত-- দিনে দিনে গানেরাও বড়ো বেশি মেকি-- কথার ভেতরে যত কথা পুরানো হয়েছি বলে-- আঁচ করা মনে হয় সাধ্যের অতীত

পাখিসংস্কৃতি

শৃঙ্গারশৈলীতে পাখিরাই সেরা-- ক্রিয়াদিতে পরিণামভোগে
এ কাজে কুশলী হতে মানুষেরও সচকিত মনপ্রাণ
গোপনে কাজেই বাড়ে সালসার দর
হাতুড়ে বৈদ্য আজও ঘোড়া চড়ে
সবলা ভায়াগ্রা নিয়ে কত লোফালুফি দেশে ও বিদেশে

পাখিদের তবে নীড় হতে পারে না কি মানুষের মন

কলাবিদ্যায় ভূমিকা আছে পাখিরও-যে বাবুই প্রমাণ
বিলুপ্ত পাখিরা যারা একদিন ছিল তাদেরে স্মরণে আনি
পড়ে দেখি খুঁড়ে পাওয়া জীবাশ্মভাষা-- গূঢ়আঁক

জুরাসিক করেছ তো মানববিকাশ-- করছও
যারা আজ নেই যুগপৎ নেই বহু সহজিয়া সুর
তাদের ভূমিকাকথা লিখে রাখি গাছে গাছে পাতায় পাতায়

আমরা যা গাই তা পাখিদেরই গান
স্বপ্ন দেখতে দেখতে যে-প্রভাতে প্রতিদিন জাগি তা পাখিদেরই ভোর
পৃথিবীতে পুরোহিত তারা আজও, ঊষা ও গোধূলির

পাথরবেলার পদ্যনুড়ি

পরাগত পরিহাস শুধু এই ক্রৌঞ্চকূজিত ভোর
দেহতীর্থ ছেকে ধরে আছে
যতটা সুরের ঢেউ মাখানো কোমল গায়ে
তার অধিক যন্ত্রণাদাহ গোপনে নিহিত

ন্যাকামোর অধিক যে গীতলতা চূর্ণিত গোপন
তা থেকে রক্ষিতে নিজে কতদিন
ঘুমযানে সকাল প্রদেশগুলো পাড়ি দিয়ে গেছি
কর্কশ ও খরখরে সে যাত্রাবলি জুড়ে
বাস্তবত ব্যঞ্জিত নির্গান শত যাপিতঘটনা

গানের আবেশ ঘোর কেটে গেছে কবে মানুষের মন থেকে
পেরোচ্ছি পাথরবেলা এই ঝামা ইটের বশংবদ দিন
ব্যর্থ হয়ে গেছে সব তৌর্যত্রিক আচারমসৃণ

নোনাধ্বনিকথা

স্তূপ স্তূপ এত-যে ভস্মগিরি ছড়ানো হাওয়ায়
এসব আমার-- আমাদের সময়ঘটিত
বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার থকথকে যেন কোনো অনিবার ক্ষত
ক্লেদ-গ্লানি রূপভেদে এইমতো লভিয়াছে আর্ত-অবয়ব

আমাদের হত-আশাগুলি
এবং তাদের শবাবশেষের এই সারি সারি বর্জ্যটিলা
নির্বাসনে দিয়ে আসি চল উপকূলে, বদ্বীপান্তরীপে--

মানুষের এইসব স্বপ্নভস্মসার
হররোজ গাছে গাছে সবুজ-অভাব
নিঠুর এই সময়কথাগুলি লেখা আছে নোনাভাষারঙে
পেরাবনে পাতায় পাতায়

পক্ষীসংহিতা

ওকে খবর পাঠানো দরকার আমি পুকুরঘাটে ঠাডেঙ্গা ফুলের বিছানে
শুয়ে পড়ছি প্রিয় কবিতা থেকে এই গরমের দিনে
কে যাবে ফটিকজল মাছরাঙা ইস্টিকুটুম কিংবা কোকিল যাবে
মধ্যগ্রীষ্মেও যে গলা ফাটাচ্ছে অযথা বটগাছে আমগাছে
নাকি ফড়িংটা-- বরঙ ব্যাঙই যাক লাফিয়ে লাফিয়ে
ও লাফ খুব পছন্দ করে শৈশবে খেলে নি বলে
আহা গোবরাকানা বিরক্ত করছ কেন এত-- অযথা ঠুকরিও না তো
এটা কবিতা লেখার প্যাড ওটা চিঠির-- এসেছ
তালুতে বসো কিছু কাজের কথা হোক এই হাত পাতলাম--
একটা খবর যে পাঠাতে হয়
হয়ত প্রজাপতির মতো গুম হয়ে বসে আছে সে-- না বলে এসে গেছি
বলছি তো জাম-খেজুর পাকে নি এখনো ওদিকটা পরে যেও

চ্রি ই ই ই চ্রি হুইপ চিপ ক্রো ক্রো চিপহি ক্রোক চ্রি ই ই ই

ঠিক আছে না গেলে না যাবে যা খুশি করগে যাও
জানি তো কাজের কাজ তোমাদের দিয়ে হয় না কিছুই--
আচ্ছা মেটেঠোঁট ওই ছোট্ট পাখিটার কী নাম গো কানাকুয়া
চন্দ্রবিন্দুযোগে ‘সুইট সুইট’ গান গাইছে যে--
শরীরে তুলনায় যাই বলো ওর গানের গলাটা বড়ো বেমানান

পড়ো ঠাডেঙ্গা ফুল পড়ো-- পড়তে পড়তে আমাকে ঢেকে দাও
ফুলের কবরে মরি
কাঠঠোকরাই না হয় সুযোগে একবার গিয়ে খবরটা দি’ আসবে যে মরেছি
এবং বাতাসা গাছের একটা আম পড়েছে দারুণ কাঁচা
আর ভুলে গেছি আসল গপ্পটা শোনো
কাঠঠোকরাটা যেন মনে রাখে যে সে কাঠঠোকরাই-- মানুষঠোকরা নয়

প্রত্নসম্পদ

তোমার শাড়ির মতো সুদীর্ঘ কুয়াশা ছিঁড়তে ছিঁড়তে যাই
তবু যেন যাই না যেতে পারি না একচুল
শরতের সব আবরণী জটিল ধাঁধার মতো

তুমি কি আসলে কোনো ধাঁধা
উত্তর খুঁজতে আমাকে আশ্বিনে যেতে হবে
কার্তিকে যেতে হবে পেছনে ভাদ্রে
শ্রাবণে আষাঢ়ে আর জ্যৈষ্ঠে ও বৈশাখে

ধানকাটা হয়ে গেলে সোনালি অঘ্রানে
খুঁজে পাব নাড়ার জগৎ বিষণ্ন বাদামি
রোদময় ফালা ফালা উর্বরা জমিন
তখন শুরু হবে আমার আসল খনন

কনকনে পৌষ-মাঘ জুড়ে
সুদীর্ঘ তোমার শাড়ির নিচ থেকে চলবে রত্নাহরণ
আমার জাহাজ ভরে উঠবে হীরা-চুনি-পান্নায়
প্রত্নসম্পদে
শেষে সুপুষ্ট ভ্রূণের স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি
জাহাজভর্তি সুখস্বপ্ন নিয়ে সারা ফাল্গুন-চৈত্র জুড়ে ফিরব বাড়ি
জলদস্যুরা আমার অদৃশ্য সুখের থেকে
এক কানাকড়িও কাড়তে পারবে না

শৈলগীতি

কাঁধে এসে ভর করো হিম শৈলচূড়া
বুকে যে পাথর আছে আত্মার ফসিল
তারে শক্তি দাও-- তোমার অতলে আছে
চোরাহ্রদ-- তারে বলো অনন্ত প্রবাহ
দিক-- পাতাল সূর্যের থেকে ধরে আনে
যেটুকু আলোক-- কোষে কোষে দিক সেধে
তারে বলো গান দিক ঠোঁটে হাসি দিক
গতপ্রাণ জেগে হোক পৃথিবী আদিম

পাহাড়ে পাহাড় গাঁথা চির অবিনাশ
বৃক্ষে বৃক্ষ সাধা অনন্ত সবুজ বীথি
বাণীময়-- মাটির আকুল করা ঘ্রাণে
খুলে যাক দপাদপ বুকের কবাট

বরফের গাঢ় চুল ছুঁয়ে আসা রোদ
মেঘের হেঁয়ালি বোঝে সবচে’ সুবোধ

আত্মপাঠ

সে তাকাতে কহিয়াছে আমি তাকায়েছি যাহা দৃষ্টিপাপ বটে
কেননা ইহা অতি উত্তম
সে বলিতে কহিয়াছে আমি বলিয়াছি যাহা সদাসত্য বটে
কেননা ইহা অতি উত্তম

সব মোহ তুমি ত্যাগ করিয়াছ জলে ছুড়িয়া দিয়াছ চাবি
বাসি প্রচলের-- সে কহিল
সব লোকলাজ তুমি ভুলিয়াছ মুখে তুলিয়া দিয়াছ তালা
যত নিন্দুকের-- সে কহিল
কেননা ইহা অতি উত্তম
কেননা ইহা অতি উত্তম

তাহারে তো দেখি নাই নিরাকার নৈঃশব্দ্যমণ্ডিত কহে কথা
কেননা ইহা সত্য স্বরূপা
তাহারে তো দেখি নাই আজনম বুকের গহিনে গূঢ় ব্যথা
কেননা ইহা সত্য স্বরূপা

আমার ভেতরে থাকে আমি কেননা ইহা উত্তম অভিরুচি
মরিতে বলিলে সে মরে যাই বাঁচিতে বলিলে সে তবে বাঁচি

শালিকপুরাণ

একটা কোনো শালিক হলো
অথচ তা দেখেই তুমি
হঠাৎ কেমন আঁতকে ওঠো
শিউরে ওঠো
রোদের মতোন লাফিয়ে ওঠো
ঘাসফড়িঙের মতোন করে
এদিক ছেড়ে সেদিক ছোটো
একটা কোনো শালিক হলো

মানুষ কোনো একলা হলেই
বিষণ্নতায় সাঁতার কেটে
কুড়ায় দারুণ স্মৃতির ঝিনুক
ডুবসাঁতারে উঠিয়ে আনে
গতদিনের দেউড়ি থেকে
হারিয়ে যাওয়া বোধের শালুক

শালিক যদি একলা হলোই
কী আসে যায় আমার তোমার
কী আসে যায় তেমন করে
গাছ-পাহাড়ের ফুল-পাখিদের
একটা কিছু যায়ও যদি
আসেও যদি
তাও তো কেবল ওই শালিকের

একটা কোনো শালিকই নয়
অথচ তা দেখেই তুমি
হঠাৎ কেমন আঁতকে ওঠো
শিউরে ওঠো
রোদের মতোন লাফিয়ে ওঠো
ঘাসফড়িঙের মতোন করে
এদিক ছেড়ে সেদিক ছোটো
একটা কোনো শালিক হলো

দুপুর

এমনকি কাকগুলিও নীরব হয়ে আছে এমনি স্তব্ধতা, চারপাশে এমনি দুপুর, ঘাসে ঘাসে ক্লান্তি, হা-পিত্যেশ ঘাম নুন আর প্রান্তর জুড়ে খাঁখাঁ সোনালি রোদ সূর্য ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম...

সম্ভবত দাসপাড়া থেকে ম্যারাথন করে এল ঝোলাজিভ কুকুরদম্পতি, এদিকে, যেখানে এইমাত্র একটি মৃত শুকনো পাতাঝরার শব্দ বাজল, যেখানটায় গোলমতো ছায়া কুণ্ডলিত সেখানটায় বসল, শুলো, হাঁপালো এবং চাটল একে অন্যকে, কিছু কি বললও, যা আমরা বুঝতে পারি না এবং বুঝতে চাই না

কোনো কাজই নাকি নেই আমার, কবির বুঝি থাকতে নেই কখনো কোনো কাজ, অনেকে অবশ্য মনে করে লাগাতার অবসর, গরুগুলো এখন যেভাবে জাবর কাটছে শুয়ে শুয়ে একনিষ্ঠ, কবিরও কেবল জাবর কাটা ছাড়া কোনো দায় নেই, বরং কবিতাবিদ্বেষীদের এইসব কথা থাক, ওই যে, আকাশের দিক থেকে বিমানের ল্যান্ডিং করার মতো নেমে আসছে যে পালকটি, উড়ন্ত চিল যেটিকে বর্জন করেছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়, সেদিকে এখন আমার মন টানছে, আর রাজ-কড়ুইয়ের যে বীজাধারটি হাওয়ায় ভেসে ভেসে ঠিক আমার হাতে এসে ঠেকেছে, যাতে চারজোড়া বীজ ছিল এবং এখন নেই, তাতে আমি ডুবে আছি, ভাবছি এই পালক ও বীজাধার, যে-দু’টো আমার আজকের সারাদিনের অর্জন, এবারের ঈদে পাঠিয়ে দেব কবির উপহার করে, প্রয়াত বাদশা সোলেমনের নামে

এই রে রে, সেরেছে বাতাস, ধুলো উড়ছে, আজকে ছুটি, ঢং... ঢং... ঢং...

পামরি পোকার পায়ের কাছে

মুহুর্মুহু কুয়াশার হাততালিতে কেঁপে ওঠে মাঘীরাত, তার পাত্রে পাত্রে শাদা মূলার মতো সাজানো আছে ফালি ফালি উরু, আমি এর একটির স্পর্শ নিয়ে, যুগ যুগ একা নিঃস্ব হাঁটি অন্ধপথ...

চরে চরে যতগুলো গরু চরে বঙ্গীয় কৃষকের, তাদের সমুদয় লোমের সমান সুতীব্র হাহাকার আমি রেখে যাই, তরঙ্গিত নদীর বাঁকে বাঁকে প্রতিটি ঘাটে, প্রতিটি নায়রীর আঁচলে লুকানো কপোতীর ঝাঁকে, দেখি যে পামরি পোকার পায়ের কাছে প্রণত এবারের সব কৃষকের হাসি, তার সবটা নিমগ্নতা বগলে চড়িয়ে বাজিয়ে বেড়াচ্ছি বাউলনাচের দুখিনী খমক, পাতার রোদনে ক্ষত সবুজতা আমি ভুলব না, এ বঙ্গীয় বিরহের যথার্থ বিমোচন নেই বিশ্বমণ্ডলে, যথার্থ শুশ্রূষা প্রেম এবং ব্যথার নিদান, তাই চরে চরে নদী ময়দানে কাঁদে অবলা বাংলাদেশ

আরো দুঃখ

দাঁতের পাটি থেকে বেরিয়ে দেখি, রক্তের দাগগুলো আলোহীন তুমুল শয্যায় শুয়ে আছে অতলান্তিক সাগরের মতো দিগপাশ দূরত্ব যোজনা করে দু’জনের মাঝে, এত দূরত্ব সাঁতরে আমি ভ্রূণচাষ করতে জানি না

চরের লোকেরা এরপর বাদামের চাষ বন্ধ করে দেবে আমাকে বলেছে, তবু যারা গর্ভে ধারণ করবে দুঃখ আরেক, বাদামের বদলে তাদের মেনুতে যোজিত হবে ‘নর মাংসের স্যুপ’ এই পুষ্টিনাম, শোনপাপড়ির মতো পথে ঘাটে ফেরি করে বিক্রি হবে মানুষের হাড়ে তৈরি খেলনা সামগ্রী, পাড়ায় পাড়ায় কিশোরেরা তাদের নিহত পিতার ছবিতে ঘুড়ি গড়ে উড়ায়ে দেবে আকাশে আকাশে, হাতে থাকবে তখনো তাদের পিতারই দেহের কোনো হাড়, লাটাই

এদের মায়েরা একদিন ঘাটে জল আনতে গিয়ে নিখোঁজ হলে, হাতের লাটাই ফেলে এরা দৌড়াবে শুধু এবং দেখবে, চারপাশে ধু-ধু করছে জলের পুত্র জল

হয়ে ওঠা বিষয়ে একটি দার্শনিক অনুধ্যান

এক আশ্চর্য হাওয়ার রাতে চাঁদের গুহামুখ থেকে যেভাবে আঠালো বর্জ্যরাশি গড়িয়ে পড়তে লেগেছিল লবণজলের পর এবং যে গূঢ় গোপন রাসায়নিক ক্রিয়ায় সমুদ্রকে ঢেকে জন্ম নিয়েছিল শক্ত ও কঠিন ঘন আস্তরণ এবং যে নিয়মে সবুজ এসে গ্রাস করেছিল ক্রমে উষর প্রান্তর, আমি সে খায়েসে এক ফোঁটা বর্জ্য ঢেলে বলি ফুটে উঠো ক্লেদজ কুসুম, বলি জেগে উঠো ফল ও বীজের সম্ভাবনা

প্রতিটা হয়ে ওঠাই পদার্থিক, চিৎকৃত মূর্ছনায় সব সৃষ্টিই মোচড় দিয়ে ওঠে জোরে-- পৃথিবীর কান্নার শব্দ যেমন সমুদ্র শুনতে পেয়েছিল একদিন, আমি সব নড়চড় তেমনি টের পাই তোমার

হয়ে উঠো, ঘন শরের মতো শাদা দুধের সংসারে ধীরে জমে উঠো আধারের গায়, সব কোলাহল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমি জেনে নেব কান পেতে সুরম্য ওলানে

শালপাতা দুলে ওঠে

রুমা গুহ চলে গেলে শ্রাবণী হাজরারা থাকে, শালবনে রাতভর শুয়ে থাকে ময়নামতি, গায়ে তার লালচাঁদ, আলোয়ান

আমার পছন্দ আমি ওর করে দিয়েছি গানের থালায়, হীনম্মন্যতা আড়াল করেছি বোকা হাসি দিয়ে, শরীর-ভাষাটা সবাই ঠিকঠাক বুঝতে তো পারে না

মাটির এত ব্যবহার শিখে নিতে আমাকে যেহেতু ফের পালপাড়া যেতে হবে, উদ্যম ও স্বপ্ন কীভাবে আকৃতি পেতে পারে কবিতায়, মৃৎকলা ছুঁয়ে-ছেনে শিখে আসব, শিল্পায়ন বুঝে গেছি শূন্য থেকে শুরু করতে হবে

ঘোরের নিচে থেকে ভেসে ওঠে বুদ্বুদ কথাদের, জেগেওঠা সূর্য-পরশে দেখি শালপাতা দুলে দুলে ওঠে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় ভারটুকু, আলো ও জলের যেন ভাবাবেগ খেলা, ভোরে যদি ঘুম ভাঙে জয় কবিতারই

ভালোলাগাগুলো মনে থাকে, ভালোলাগা স্থায়ীদাগ, অত দ্রুত মুছে-টুছে যায় না বস্তুত, এইগুলি, ঝনঝনে ভালোলাগা মিলেমিশে চিদাকাশ, যতটাই হাঁটা যায় মঙ্গলবাস

রূপকথা

স্বপ্ন তাকে শুভেচ্ছা দিয়েছিল তিমিরাকুল গিরিগুহা আর কাকতন্দ্রা থেকে জেগে গাঙুড়ের জলে মুখ ধুয়ে সে ঘোষণা করেছিল অজন্তা ইলোরা... আক্রমণের জবাবে তাকে বারবার পাল্টাতে হচ্ছিল ছেঁড়াতার, মুখে ফেরা সুর সংকটের চাপা ক্ষোভ, শিল্পহীনতার অভিযোগ

হেরপর কল্লো না তো কল্লো কী

জল এল বরফকুচি পাতিলেবু... সরাবিক প্রতিদিন ঘোরের অতল তলে জগৎ সৃজিল, দেয়ালে দেয়ালে যত গুহাচিত্রের নাম গেল সেঁটে, আর ছেঁড়াতার বাঁধতে বাঁধতে মনে দেখল সে, মাল্যহস্তে দুয়ারে দাঁড়ায়ে আছে শিল্পের দেবী

হেরপর

চোখের পাতায় জেগে থাকল অনিদ্রা-পরী, ঘুমমত্ত ছায়াসাথী নিশিরঞ্জনা, শ্বেতী জোছনায় লাগাতার হৈ-হুল্লোড় আর হাঁটুর ভাঁজে ভাঁজে মৃত্যুকে সহবাসী করে আয়াসে জীবনপাতী লিখন প্রক্রিয়া

হেরওপর

ঝাঁক ঝাঁক সারসির ধলাপাখা দুলে উঠল আকাশের নীলায়, পৃথিবী তাকাল তার দিকে আর ঘাসস্থান খুঁজে নিয়ে ধীরে সুস্থে শুলে সে তার শোকে পঞ্চনিশি রোদন করল বৃক্ষ এবং পাখি

সৃজনশীল অন্ধকার

সেই নামবেই যদি জানতাম, নিজের থেকে পালিয়ে এই আমি এত পথ কিছুতে যেতাম না হেঁটে, বরং ওখানেই, যেখানে দাঁড়িয়ে প্রথম শুনেছি ঘণ্টাধ্বনি, ছিঁড়ে ফেলতাম হাতের রাখি, আর নিরাপদ দূরত্বে থেকে যত দুর্গন্ধ আছে দিতাম প্রচল বিদায়

পরের যে চৌবাচ্চা তার জলে কী আছে অধিকার আমার মুখ হাত ধোবার, ওই জলতোলা মগ আমার স্থাবর নয় অথবা অস্থাবর, জলের বিচিত্র ছলাৎ শব্দেরা দিগপাশে ছড়িয়ে দিল যে রহস্যের বাতাবরণে ঘেরা শিশু কৌতূহল, তার নড়েচড়ে ওঠা অবধি আমি একসা উদোম

তবু আঁধার ছিলে ওহো রাত্রির মধু, অথবা এই ছিল অনিবার্য শিবে রূপান্তর, লিঙ্গ নিয়ে সুনিপুণ দার্শনিকতা

এক আঙড়া প্রজ্জ্বলন

এক শ’ একটা বস্তুভার উচ্চে উঠিয়ে জেনেছি অহঙই মূল্যবান এ ক্যাকটাস বনে, অনিদ্র কাঁটার আঘাতে যত রক্তক্ষরণ, নিজস্ব নিভৃতে পোষে পাতার ক্লান্তিকে

সাহসের নাম পর্বতশিখর, ভয়েরে সমুদ্র বলি, কল্লোলগুলো স্থিতিনাশী, কেতকি ফলের কাছে করুণা ভিক্ষা চেয়ে তিল তিল বেঁচে থাকার এ প্রার্থনাবাণী শুনিয়ে গেল বুঝি প্রহরপ্রতিমা

পরাহ্ণে আলোই ঈশ্বরী দেবী, ঘুমের ছায়ায় ছায়ায় বনের গরিমা সব পাতার গহনে যে রূপ ধরে রাখে, তারে দিতে পারে মূর্ত ক্ষমতা, তার বাণীগুলি ছড়ে’ থাকা অমোঘতা ভেঙে ডিমে কেন্দ্রিত জাগৃতি করে প্রভাবন, ধরে অনুকাল আকৃতি

নিঃস্ব রাত্রিকে করি জয়-জুলুমত, শরীরে থোকা থোকা ঝুলে থাকে লাল-লাল ফোলা-ফোলা নিদ্রাকুসুম

সত্য

ওই খড়ের ঢিবিটা সত্য, সত্য কৈবর্ত পাড়ার সতীশ যে এখন জাল ঝাড়ছে এবং তার খালই ও কোমরের গামছা সত্য, সত্য কুকুরের ফুলে ফেঁপে ওঠা উলটানো লাশ, যেটি ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করছে অবিরাম, প্রবহমাণ ধূলি যারা বালিয়াড়ি গড়ে সে কি মিথ্যা এবং হাওয়া সত্য আর শুকনো পাতারা, সত্য বালিকাটি ওড়নাবিহীন, যে তার ভাগ্নেকে এগিয়ে নিতে এসেছে আর্টস্কুল থেকে এবং যে তার দুলাভায়ের প্রিয়পাত্রী এবং যে তার নিষিদ্ধ স্বাদ আহ্লাদের চাষ করেছিল এরকমই এক ধুলোটের দিনে গতবার, তার কাছে জানতে চেয়ে দেখ, স্বর্গে ফ্রি সেক্স থাকছে কি থাকছে না এ তর্কে সে কেমন নিষ্পৃহ, বরং এখন ক্ষুধাটা সত্য, আর সত্যটা সত্য রবে যত তুচ্ছও দীর্ঘ হোক আমাদের বাচাল জীবন

স্বপ্নবৃক্ষতলে

বল হে সন্ধ্যা ফাগুন দিনের, বল হে আধো তমসার শস্যহীন মাঠ, বল হে প্রাচীনা নদী, বল হে জরাজীর্ণ স্নানাগার... ঝরাপাতা... বালুচর... আমার সেসব পাপড়ি ঝরিয়ে দিল কেন পুবাল বাতাস

শিমুলের শাখে শাখে সধবারা মাথার সিঁদুর জমা রেখে পরাহ্ণবেলায় নাইতে নেমেছিল, একথা ভুবন বলে গেছে বাতাসের মতো কানে কানে, ভুবন রবি কাকুর সেজো ছেলে, কারো কোনো অকল্যাণ চায় নি বলে গেল বছর পাখিদের সিনেটে সে সুনাম কুড়িয়েছিল, এখন এই সন্ধ্যায় তারা মানে সধবারা, ভালোয়-ভালোয় তাদের ভেজাসুতি বদলানো হয়ে গেলে সার সার ঘরে ফিরে যাচ্ছে পুনঃসিঁদুরচর্চিত হয়ে, আর সব পাতাহীন শিমুল গাছ, বিষণ্নতা সমভিব্যাহারে ঘুমুতে যাচ্ছেন রাতের শয্যায়

পশ্চিমে পুকুরধারে, পিতামহ নাক ডাকাচ্ছেন যেখানে যুগপ্রায় শব্দহীন, তার ঠিক পাশে যেসব গমখেত এখন অপেক্ষা করছে পেকে ওঠবার, চঞ্চলা বাতাস এসে একটিবার নাচিয়ে যাবার পর, আকাশের দিকে চেয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে, আকাশে অর্থাৎ আলোর বাগানে, যাতে ফুটে আছে রাশি রাশি জ্যোতিষ্ক কুসুম, অথচ তাদের, ভুবন যা বলে গেল, উল্লেখ করার মতো কোনো ক্ষয়ক্ষতি নেই, হতাহত হয় নি তার একটিও অপুষ্ট শীষ

স্বপ্নবৃক্ষ আমার, যার পাপড়ি ঝরে গেল বলে আজ এই উত্তীর্ণ সন্ধ্যায় শোকসভা বসিয়েছি, তার তলে এখন ছড়িয়ে আছে সব মৃত স্বপ্নের হাড়গোড় কঙ্কাল, ঠিক বোশেখে যেমন ঝড়ের তোড়ে ঝরে আমের বিকশিত বোল, এই আমি স্বপ্নহীন, কার পানে চেয়ে চেয়ে কাটাব আমার অনাগত কাল

বর্ষাতিটা

আমার ছিল না, বর্ষাতিটা গারোপাহাড় আমাকে দিল, একদিন বৃষ্টিশেষে শারদানুকূল্য ফিরে পেলে পৃথিবীটা, যেকোনো কুরিয়ারে ওটা ফেরত পাঠাব, গারোপাহাড় আমাকে নিকটস্থ ডাকঘর রানিখং থেকে জরুরি চিঠি লিখবে, যুবতী সোমেশ্বরী হারাযৌবন বিধবা হলে চিকচিক শাদা বালুর শাড়িতে, আমি সেবার গিয়ে গারোপাহাড়, তোমার পাতাঝরা বিশীর্ণ কানে নিজহাতে পরিয়ে দেব কানফুল, বনজ-কারুকা, দেখি যদি দূরে পাহাড়ে হাঁটছে আগুন, দিগ্বিদিকে বৃক্ষগণের করুণার্তি রণিত হাওয়ায়, তবে দলছুট মৃগশিশুর উদ্ধার কাজে অন্য কোনো জলঘেঁষা উদ্যান চাব, অরণ্যে আগুন লাগলে কেউ কান্না তো করে না কখনো বর্ষাতি বর্ষাতি বলে

হিজলের পাড়ার দিকে

কালোর আলোয় ছিনু মুগ্ধ প্রভু, আর কোনো গান নেই জাগাবে মহিমা, ওইভাবে কখনো জাগি নি কোনো যাত্রায়, গরিমা সকল র’ল গৌরনদী

বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই আকাঙ্ক্ষা ঝিনুকগুলি বুকে চাপা, জেগে জেগে নদীর ওপাড়ে আর কে জানে কাদার মতো তীরের কাছেই ছিল ঘুম খাড়া, বেয়াড়া প্রেমিকা, হিজলের পাড়ার দিকে উড়ে গেল বনের নন্দন

প্রভুর করাঙ্গুলি ছুঁয়ে বলি, ও আমার প্রণয়-এষণা, একুনে একবার দৃষ্টি পেতেছি মানবীর দেহে, তার স্থাপনা সজ্জায়

আক্রান্ত হবার পর

শংসাগীতি তো বেশ শোনা হলো, এবার আক্রান্ত হবার গল্প বল তো শুনি, কোথায় কখন কবে একা একা, বাঘের সামনে গিয়ে পড়েছিলে, সিংহের হুঙ্কারে জলের পিপাসা পেল কোন-সে বয়সে আর গায়ের গন্ধ শুঁকে পাশ কেটে চলে গেছে বন্য বরাহ সেটা কার কল্যাণে

কুকুরপ্রজাতি জেনো বরাবরই এরকম, আদর বুঝতে পেলে ঠোঁটে-মুখে চাটা দিয়ে দেয়, আরামবিলাসী কিছু বিড়াল আছে পায়ে পায়ে উষ্ণতা খোঁজে, এসব তো হায়েনার কবলে পড়ার চেয়ে বড়োবেশি তুচ্ছ ঘটনা

বল, যেবার যুদ্ধ হলো কুমিরের সাথে সেটা কোন জলে নেমে, আঁধার ঘরের মাঝে চুপিচুপি গায়ে এসে হামলানো নেকড়েটা কীরকম জেদি ছিল বল তা-ও, কখনো কি বিষধর সাপেদের কবলে পড়েছ, আর সেটা পথ না অরণ্য ছিল

তুমি যে হরিণ পোষো ভালোবেসে, না জানিয়ে সে-ও তো মাঝেসাঝে গুঁতো দেয় জানি, মাথায় যে জটিল শিং ডালপালা, চূড়ায় চূড়ায় তার লালাভার ছোপ লেগে থাকে

শোন, প্রচ্ছন্ন অথচ স্পষ্ট এক সম্পৃক্তিরেখা বয়ে গেছে জীবকুলময়, যে কারণে লোকালয় ও শ্বাপদসঙ্কুলতা গোপন এক বিন্দুতে এসে মিলেমিশে গেছে, এইকথা নিজে থেকে শিখাতে লেগেছি আজ সমুদয় মাছের মায়েরে

পত্রদূত-- একটি লংশট

ওপাড়ে প্রথমেই মিষ্টি আলুর খেত তারপর কাজলা গাভিটা তারওপর অফুলা কাশের বনের পাশে শকুন একপাল কুকুরের সাথে বচসারত কাক গোটাকয় এবং মাছিরা এবং ডোবাটা ডিঙিয়ে পরে ধূম্রকুণ্ডলি খেসারি খেতের তারপর খেজুরের বন বালুচর শশাখেত আর বাদামের বিস্তীর্ণ মাঠের শেষে যে গ্রামটি দেখা যায় তার সাথেই গলাগলি করে আছে চৈতিদিগন্ত তুমি যদি যাচ্ছই যাও নদী পারাপারে পয়সা লাগছে না এবং মনে রেখো বাতাসও বেজায় হিংস্র একটু মানিয়ে চলো যাতে উঁচু গাছ-গাছড়ায় অথবা আগুনের আশেপাশে তোমাকে না ফেলে যায় জেনে রেখো তুমি শুকনো পাতা ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বলি চরিত্রে কিছুটা বিনয় অন্তত রেখে সামনে দাঁড়ায়ো এবং বলো-- কবি বসে আছেন ওইপাড়ে নদীর আর তার কাছে কোনো সিগ্রেট নেই আর ঘণ্টা দুয়ের ভিতর তার অবধান দরকার

জাদুগুহা

এত-যে শব্দপ্রবাহ, এর কোনখানে লুকিয়ে আছে সত্য সুপথ-- জানি না বুঝি না তাই ডুবুরির পোশাক পরেও ডুবে যেতে পারি না কোথাও-- কে যে সে-ই ভেল্কি লাগিয়ে চোখে রেখেছে মুগ্ধ করে-- ডুবে যাওয়া হয় না সহসা আজও খুঁজে পেতে গূঢ়-নব-ঐশী-শেকড়-- যেজন ধূর্ত ছিল, আগেভাগে তুলে নিয়ে চাবিখানি আটকাল তালা-- মন্ত্রজরির মালা গাঁথতে পারি নি বলে কোনোদিন ভালোবেসে রহস্যমদির গুহা হা-হা খুলে যায় নি সমুখে-- এই এক জনম আমি গুহার বাইরে থেকে দেখে যাই পথিকের লাভালাভ-- গহন হৃদয় ফুঁড়ে উঁকি দেয়া অমরতা কাঙ্ক্ষা-পরম--

আর ধ্বনিপ্রেমে আমিও কি কথার ভুবনব্যাপে করছি না রাতেদিনে অক্লান্ত বিহার-- জানি একদিন খুলে যাবে গোপন দরজা সেই-- জাদুগুহা ডেকে নেবে ‘চিচিং... চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রোচ্চারে

মাঠকর্ম প্রতিবেদন

এবারও শীত এসেছিল সর্বশক্তি নিয়ে গাছে গাছে পাতা ঝরানোর কাজ শেষ করে এখন সে যাবার উদ্রেক করছে হাঁটতে হাঁটতে উদ্যানে না ঢুকে গেলে শোন এ মৌল ঘটনাটা টেরতামই না বাউরি বাতাস

পাতাকুড়ানি বালিকারা মনে করিয়ে দিল গত শীতের ধ্বনি আমি যে ঝরাপাতার গান না শুনে গৃহে ফিরব না কাকের চিৎকারের চে’ বাতাসের চুমুর শব্দই এ ঘোষণা ছড়িয়ে দিয়েছে আলগোছে নগর প্রান্তরে তবু যাই বন্ধুরা বেজায় খেপিয়ে তুলেছে অফিসে অসম্মানী ফাঁকা গুলি হরতাল পথে পথে খেঁকিয়ে উঠছে দেখি কুকুরের মতো

বাতাসের মন্দিরে এত-যে মৃদঙ্গ বাজে পাখিদের গানার্ঘ্য এত জুটিবাঁধা মানুষের স্বপ্নগুলির কাছে একদিন খুব করে কেঁদেছিল হাসার দায়ে

পার্কে এসে টান দিয়ে ফুল ছিঁড়ে ফেলবার আমার কোনো অধিকার নেই বস্তুত তবু কেন যে ছিঁড়লাম দু’টো জামরুল ফুল পাতাসহ পাতাগুলো ফেলে দেই পরে নেংটো করে বুঝি মানুষের কাজ শুধু কৃত্রিমায়ণ

ছোট এনজিওর মতো বাজার সৃষ্টিতে আছে শিক্ষানবীশ বেশ্যাটি দেখে আমি তছনছ হয়ে যাই বালিকা বাধ্যার মতো চিৎকারি সতীচ্ছদ ছিন্ন হবার মতো তবু ঘুরেফিরে নিভৃতে ডেকে আনা কবিতার ছলাকলা আমি বুঝি না তার উরুর বাণিজ্য কবে শেষ হবে তা জানাই হলো না প্রিয়ঋতু এই শীতশেষ-বসন্তশুরুতে মানে মাঘে ও ফাল্গুনে আমাকে সে প্রেম প্রেম খেলা খেলে বেঁধে রেখে চলে যায়

ও আমার বারোমাসী প্রেম তুমি প্রবাসী নগর থেকে কতদূরে থাক বাকিমাস

চিহ্নবিজ্ঞান

কেবল পদক্ষেপণ ছাড়া এ হাঁটার কোনো অর্থই হতো না, যদি না থামতাম পথে যেতে, কমার মতো রোপিত বোধিবৃক্ষের নিচে

বিরামচিহ্নের এ বিরল ব্যবহার আমি গাছপালা থেকেই শিখি, এটা ছিল আয়োজিত বন, সারি সারি একই গাছ চোখ যতদূর, শোন, ঝরাপাতার গান বিষয়ে যে গদ্যটা আমি লিখব বলে জানি, সেটারও আশকারা পেয়েছি অরণ্য চিহ্নবিজ্ঞানেই, দেরিদা বা রলা বার্থ লাগে নি হে

বুকের থেকে পুবদিকে খোলা আমার কোনো জানলা ছিল না, আজ হয়ে গেল, দক্ষিণেরটা ছিল আমার পিতার থেকে পাওয়া আর উত্তরে পশ্চিমে হোক কোনোদিন চাই নি তো, দেখ, এটুকু পুঁজিতে চলে বাতাসকথন, প্রেমালাপ, ভাব বিনিময়ের এই যে নতুন কায়দাটা আমি শিখে গেছি, তাতে তাকে বলব যে, জাতপাত নির্বিশেষে, সকলের কাছে যেন ঠিকমতো পৌঁছে অক্সিজেন

পথালাপ

বসন্ত’দা, খুব তো জারিজুরি দেখালে, এবার ফোটাও তো কুসুম কত পার, গেল সপ্তাহে সে আসবে বলেও আসে নি, কেমন চুতিয়া দেখ, আমিও বাপু খাপ ধরে আছি বেজির মতন, পরবর্তী যে তারিখ আছে আগামী সপ্তাহে, যদি আসে ও, গোক্ষুর কিংবা দাঁড়াশ যাই হোক এই বলে রাখলাম, ধরে বেঁধে এনে ওকে বিয়ের পাটিতে আমি বসাবই, তুমি দয়া করে শিমুলকে বলে রেখো ওইদিন খুব করে যেন ফোটে, কোকিলকে বোলো যেন ডাকে, প্রজাপতি যেন উড়ে, আর গুনগুন গায় যেন মক্ষিকারা, আমি দেখি, এই ধুলোটের দিনে খুব অসুবিধে হবে না যদ্দূর জানি পলাশকে খবর পাঠানো, ধুলো’দা হাওয়াযোগে ওইদিকে প্রত্যহ যাওয়া-আসা করে, আর পলাশ তো পশ্চিমেই থাকে নাকি নিমগাছটার পাশে, বলি বসন্ত’দা, তুমি তো জানই আমি বেকার জাতীয় প্রাণী, পকেটে পয়সা-টয়সা খুব একটা মানে ইয়ে মানে ভাড়াটাড়া ঝামেলা, নইলে আমিই যেতাম, বলি কী বাকি সব আত্মীয়স্বজন তোমার যারা আছে, ধর পারিজাত করবী অশোক নীলমণি গং, ওদের সকাশে কাউকে পাঠায়ো নিউজটা দিয়ে, আর যদি পার একখানি গণঘোষণা দিয়ে দিও অরণ্যে পর্বতে, ‘যত সব গাছ আছ বন্ধ্যা-টন্ধ্যা, পারলে ফোটায়ো ফুল’-- আমি দেখি, এই ফাঁকে আর সবকিছু গোছগাছ করি গে যাই আদাব

কল্পকাম

কখনো পাব না ছুঁতে নীহারিকা এটা বুঝে গেছি, বুঝে গিয়ে কাগজে লিখেছি তার নাম, এরপর হাত দিয়ে মুখ দিয়ে নানাভাবে ছুঁয়ে গেছি তারে, যেমন খুশি তারে পেরেছি বাজাতে, সরোদে গিটারে বা বীণার ঝঙ্কারে যখন যেভাবে চাই, হাত দিয়ে সেইমতো সুর তুলি, সুরের পরশে মেতে দুধস্বাদ ঘোলেই মেটাই, নীহারিকা আয়ত্তে আজ গোটাটাই

তারে ছোট করে বড়ো করে কনডেন্স ও এক্সপান্ডে যেকোনোরকমে লিখি, অঙ্গমাধুরি দেই ফ্যাটিয়ে-ফাঁপিয়ে, কখনোবা লহমায় স্লিম করি, নীহারিকা এখন তো হাতের পুতুল

আমূল পাব না তাকে এটা বুঝে গেছি, বুঝে গিয়ে নামের দেহ থেকে বস্ত্র সরিয়ে আনি রতিভাব, নানারঙে প্রিন্ট নেই, প্রিন্ট নিয়ে প্রিয়টার উপরে জোসে শুয়ে পড়ি, মনে ভাবি এই তো পেয়েছি তারে, এইবার নীহারিকা কেবলই আমার

কাব্যোপনিষদ

নতুন কবিতা বস্তুটা কী এ জিজ্ঞাসা আগে ঠেলা দিয়ে ফেলে কবিতা কী এর কাছে, কবিতা যদি চেনা যাচ্ছে না জানা যাচ্ছে না নূতন কবিতা তবে চেনা-জানা যাবে কী প্রকারে, ওটি তখন আরো ধোঁয়াশা-কুয়াশা জঘনে অবলুপ্ত

ছিল না যা দেহাবয়বে, অন্তর্কথনে-বয়নে, সম্ভাবনার কোটরে কোটরে যারা ছিল, তাদেরই আবির্ভূতি হলে তা নতুন ধ্বনি, বাতাসে-কিংখাবে-শূন্যে ছিল, কার্বনদণ্ডে, নানা সংশ্লেষণে, রোদনে-বিলাপে ছিল আচারনিষ্ঠতায়, নাওয়া-খাওয়া চোদনে-চুম্বনে

নতুনের ভর বেশি নতুন চুনের মতো, জিহ্বা হবে ডিনামাইট পড়া দগ্ধ সেতুর খাল, বোধে যেতে বাধবে পাঠকের, ভোগে যেতে, কেননা চুরমারের যৌবন হলো নতুন, নির্মাণে-বিনির্মাণে কালব্যঞ্জনা, ভূয়োদর্শন

নতুন কবিতা কবিতা নয়-এর মতো ও নতুন নতুন থাকে অচিরকাল

ক্রান্তিকালের গান

বিকেলের উপকণ্ঠে এসে যে-বেলায়
রাত্রির গভীর মাছি
তার অগ্রজ সন্ধ্যার নাকের চূড়ায় বসে
শুঁকে যায় সমাজেতিহাস আর
ক্রান্তির সময় ঘোড়ায় চড়ে
পলকে পাড়ি দেয়
হাজার বছর দীর্ঘ এক স্মরণ সংগীত
আরো এক
হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নদীদের
যাবতীয় ছলাচ্ছল লিখে যেতে
আমিও তেমনি তার তীরপথ বেয়ে বেয়ে
দাঁড়িয়েছি ঘোরতর মোহনায়

আগামীর জলযান
কতটুকু ঘাতসহ হলে পরে
ডুববে না প্রবল স্রোতেও
পাঠ নিতে তড়িঘড়ি এই নৌবিদ্যার
স্মৃতিকোষে পৃথিবীর নদীদের
সমুদয় আবহাওয়া গচ্ছিত করি

জলের যে সাধারণ গতি-প্রকৃতি ও
খেপামো ডেপামো
এতটা বদলে যাবে
মানুষের অভিজ্ঞতা
এইকথা কোনোদিন জানতে পারে নি

আমরা নদীর শিশু
আমরাও বদলাব
অভিযোজনের রীতি মেনে-টেনে
প্রচণ্ড অথচ প্রেমময়
ত্বরিৎ অথচ অনধীর
রহস্যময় অথচ স্বচ্ছ এক রেখা বেয়ে
সুগ্রীব পাথরে বসে
পরে নেব বিনির্মিত আচরণবিধি

সংক্রান্তি দিনের সব গীতিকার অনুভাব
বাতাসের সংগ্রহে থেকে যায়-- থাকে
তা না হলে এত সুর ভিন্নতাবিস্তারী
কস্তুরী মৃগের ন্যায় নাভিদেশে
কী করে সে জমা করে রাখে
ঘ্রাণ দেয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে সব
--অভয়-উদ্যানে

এই এক প্রতিবেশী যে নিতিকল্যাণ
ভুলে গিয়ে
কখনো জলের সাথে যায় সন্ধিতে
তাই এ ক্রোধোন্মত্তকালে
ভালোবেসে তারে কিছু খড়কুটো ধারে দেব
উড়ায়ে উড়ায়ে সে সব নিরস্ত হবে
কেননা সে কৃতজ্ঞতা বোঝে
আমি যতদূর জানি

শীতার্ত সেমিনার

ভাঁড় পর্ব

তাঁবুর হাত দুয়েক দূরে বন্য ছাগলের কাশি
এই উদ্বোধন
আজকের চাঁদরাত কুয়াশা শীতের গুনগুন
কম্বলের জোর আঞ্জাম সফল হোক
আমাদের আজকের কৌতূহলী
শখের শিকারি পাতাকুড়ানি ও বাওয়ালিজন
স্বাগতম

কৌতূহলী পর্ব

সব ঠিকঠাক আয়োজন
ঘন বুনটের এই পই পই রাতে
রহস্যখনিতে যাই তলে’
তাঁবু পড়ে থাকে শুভ্র কুয়াশার নিচে
এই বৃষ্টিতে ভালো আছি আলোর

আস নিজেরাই আজ বসি নিজেদের বিচারশালায়
সবাই সবার সমান এখানে
সবারই আছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ
অখণ্ড যুক্তিতে বল-- আমরা কে কেন বেঁচে আছি
কেমন করেই বা

শিকারি পর্ব

কার্তুজের চে’ সত্য জগতে নেই
হরিণ কিংবা ব্যাঘ্র অথবা বনের রাজার শালী
তারো চেয়ে বেশি স্থিত দু’নলা বাহানা

জীবনে বন্দুকই আসল

পাতাকুড়ানি পর্ব

শীতে আগুনই মুখ্য-- চিরাত্মীয় প্রেম
তাপ চাই সম্পর্কের চেয়ে বেশি
গাছেরা যে-কারণে জরুরি আমাদের
কাঠুরে যেজন বনের মর্ম কাঁদায়
তারো চেয়ে সৎভাবে বাঁচি
গাছের ইচ্ছেয় আমাদের বাঁচা-- মরা

বাওয়ালি পর্ব

মধুই আসল তাই
সহস্র হুলের আঘাত পরোয়া করি না হে প্রেমে
বলারিস্ট এর চেয়ে ভালো পৃথিবীতে নেই

কাঠুরে পর্ব

যতদিন কুঠারে আছে পর্যাপ্ত ধার, আমি ডরাই না
ডরাই না বাঘ সর্প কারে
গামছায় লম্বিত শক্ত দাঁড়াই, জোর হাতে কোপ দেই
কড়কড় শুয়ে পড়ে বিশাল জানো’র

সবচে’ কুঠার সত্য

পিঁপড়ার ডিমওয়ালা পর্ব

সব সৃষ্টিই জগতে মূল্যবান শুনেছি ইঁদুর বাদে
ক্ষুদ্র এ পিঁপড়েরা আমাকে বাঁচায়
ইষ্ট সাধনে কষ্ট জরুরি তাই
সহাস্যে কামড় খাই
চাই পিঁপড়ের প্রজনন ক্ষমতা বাড়ুক
আরো বেশি ডিম দিক
পরিবার পরিকল্পনাদেশ অমান্য করুক

ভাঁড় পর্ব

বা হা হা বেশ-- কথা তো শেষ-- সব চুপচাপ
স্ব-পেশায় নিষ্ঠ সব জন
সুষম চোপার জোর সকলের
সমঅধিকার যাপন করে সবাই এই বনদেশে
ধন্য চাঁদরাত-- বন ধন্য আজ তাঁবুযোগ পেয়ে

কৌতূহলী পর্ব

বিস্ময়ে হেতাল পাতার মতো চক্ষুব্যায়াম
কে মেটাবে তৃষ্ণা-- তুলে এনে জবাব স্তব্ধতা থেকে
জন্মেছি তৃষ্ণা কাতরতা নিয়ে
প্রাণপণ আকুলতা ধরে বাঁচি

শুধু চিৎকার চেঁচামেচি আমরা সৃজন করি গর্বে
রক্তহোলি খেলা যেন আগুয়ান
সব মিথ্যা আয়োজন তবে এই তাঁবুর সংসারে

আহা কী সুদীর্ঘ বঞ্চনায় পতিত আমরা আজ
উপবনে-- প্রেমহীন ভালোবাসাহীন

এলেবেলে

চোখ ছিল জলেই নিবিড় এলেবেলে
কুমুদ মঞ্জিলে ভেজা অন্ধকার
বৈষাদিক শৃঙ্খলে বাজে হাওয়া
দূরত্বে মুখরিত দেখি ভয় আরও সংশয়

নূপুরের অপেক্ষিত ধ্বনি বাজে না বাজে না
স্বপ্নে ওড়ে ঘুঘু বাতাবি মূর্ছনা
সহসা প্রসঙ্গিত অস্থিবাস ক্ষতদেহ নালিঘাস
তোমার অলিতে লিখি গূঢ় ইতিহাস

প্রতিটা অকৃতকার্যতা একেকটা পরীক্ষা
গলিতে গলিতে গজা চারাগাছ
সে আলো পেরিয়ে যাব ছেঁড়াভাঙাসহ
সালকিয়া ভেসে ওঠে আভাসে ইঙ্গিতে
জানি না শুনি না কিছু সালকিয়া ভেসে ওঠে
বহিরঙ্গে জেগে ওঠে নগরেতিহাস
সালকিয়া ঘুরে গেলে কী জবাবি লিখে

ফোলা ফোলা ভাঙাজল নীরবে মেতেছে
কামিনী কাঞ্চন থাক চুলে ঢেউ
মনে ঢেউ হতে পারে আরেক পরীক্ষা
নৌকাডুবির সন্ধ্যায় ছিলে ঘাসের কিনারে
বাতাসে উত্তাল নদী রূপার ভাসান
কালো রাতে চারচোখ চারটে জোনাকি
ঘনজাল ঢেউ পড়ে হামলে
মরি গাঙ্গেয় দ্বীপে
দেখি উদ্ধারে আসে কি না বিষলক্ষা নারী

চোখের কিনারে মরি
দূরাড়াল ভেঙে পড়ে নিবিড় দৃষ্টিতে
মিথ্যা সমর্প্রমাণ
প্রেম কি নিত্য আহার
তারও বেশি তারও কম চাওয়ার পরিধি
অতি সূক্ষ্ম বাণী অমৃতম
শস্য সৌরভে সে কি থাকে

আকাঙ্ক্ষা শস্যে নিহিত
বছরের বায়না রাখি লিখে
কালশীতে চোখ হারায় কাব্যাবরণ
এত বেশি আন্ধা রাত্রিতে
হাড়গোড়ে আঁতকে ওঠো না ধুনী
খুলে খুলে এটা শিং কাঁটা এই
বাজাও ধমনি আঙুল
পালকের জলসহ স্বপ্নের হাঁস
এ দিঘিতে কাদা ঘুটে ডিম্ব ফলাক

জল চিনি কী যে নদীরে বলব ভাই
যা যবে দরকারি যে যবে তাপের সুরমা
তারে বলি জীবাঙ্কুরণ
কথামালার ওদিকে নেই চিকিৎসা বিশেষ
বুঝি থেকে যাব
মানুষ মন্ত্রণা মানে
মেলে দিলে জবাঘাটে আলোর পসর

কাকে শাখ বলি
সুধ্বনি কুধ্বনি বহু উড়ায়েছি গোলরাতে
কারে কে ঠোঁটে নেবে কেউ তা জানে না
কিসিমের বন্ধুমহলে কারে বলি সাথী
কে নেবে বুক পেতে মূর্ত স্খলন

ভালোবাসা খুন হয় গৃহের ভিতর

চমৎকার বাতাস বাইরে
গাছের শন শন
এতদূর এই গৃহে প্রণোদিত জানালার গুণে
বিগলিত মেঘের গভীরে
চাঁদনারী এ্যাকুরিয়ামে আলোক মাছ
লেজ নাড়িয়ে তীব্র দেখাচ্ছে কেরদানি
আকাশ কাশফুল ছাওয়া

সারাঘর তন্নতন্ন করে ক্ষুধার্থে টহল দিচ্ছে
ধূর্ত বটে অলক্ত বেড়াল
মাটি থেকে টেবিল সোফা থেকে আলনা
অবশেষে আলমারি এবং খটাস

পরিবেশ রচনার এ পর্যায়ে
ঘন ঘেউ ঘেউ ব্যাঙের কোরাস
ঝিঁঝি পোকা আর ঘুমন্ত মানুষের
পাশ ফেরার ধ্বনির উল্লেখই
যথেষ্ট হতে পারে এবং
নরকের শব্দের মতন চিৎকার

বাতাসের পরতে পরতে লেগে থাকা
ফুল্ল ভেজা ভেজা যৌনগন্ধ
কর্পুর স্বভাবে ঊর্ধ্বে ওঠার ডানায়
ভর করে উড়ে যায়
আর মাছের অ্যাঁশটে গন্ধযুক্ত গাঢ় রক্তপাত
নয়া এক আমোদিত খেলায় আচ্ছন্ন হলে
দিগ্বিদিক শিমুল তুলোর প্রায়
উড়তে থাকে কান্নার স্বেদ

খাঁচাবন্দি পাখি আর পাখিই থাকে না
ব্যর্থ উড্ডয়নাকাঙ্ক্ষাগুলো ক্ষতের যন্ত্রণা দেয়
গান হয়ে যায় বিষাদের গীত
সুর-তান বেদনার...
ভালোবাসা খুন হয় গৃহের ভিতর

জোয়ারি খলসে মাছের মতো টগবগিয়ে ছোটে
উচ্ছ্বসিত রাঙা রক্তদল
হাওয়া হয়ে যায় জলাভূমি-- রাত্রি স্রোত
নরকের শব্দের মতন চিৎকার
সময়ের জলবায়ু
আর হি হি হেসে ওঠে জ্বলজ্বলে বটি

ব্যাপ্ত বনের ছায়া সবুজ ভালোবাসা
পাখিদের শিস যত শিখে নিয়ে তবু
বিছানায় পেতেছিল বনানী আঁচল
পাশাপাশি জেগে ওঠে ফণিমনসা
ট্যাঁওরা কাঁটা
হলুদের বনগুলো লাল আসমান
রঙ বদলের গুঢ় খেলা
গোধূলির নাচদৃশ্য জাগে অস্তরাগে

খেয়ালী উচ্ছ্বাসে ভাসা মনোবেগ
কূলে ঠেকা দুরন্ত ইচ্ছেটা
একদিন পালক গজাবার আগেই
সেরেছিল উড়বার সমস্তায়োজন
তবু মেনে নেয়া গেল বেশ
কিন্তু উদার জানালা
যার আকাশের দিকে মুখ
খোলা ছিল না তো
বিহঙ্গ তপস্যাগুলো
খাঁচার বন্ধনে শুধু তড়পায়
নুয়ে আসে ধীরে-- লৌহভূমে
ঝিনুক যেমন মুখ ব্যাদান করে
লুটায় সেজদায়--
জেগে ওঠে তীব্র চিৎকার
নরকের শব্দের মতন
বিভীষিকাময়
আর রক্ত
ভালোবাসা খুন হয় গৃহের ভেতর